• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

মিল্টনের বিরুদ্ধে তিন মামলা : তিন দিনের রিমান্ড

কংস মামা কুপোকাত

  • ''
  • প্রকাশিত ০৩ মে ২০২৪

এম এ বাবর:

সহায়-সম্বলহীন অসুস্থ ও ভবঘুরেদের আপন আত্মীয় হিসেবে পরিচিত মিল্টন সমাদ্দার এখন পুলিশের জালে। তিন মামলায় কুপোকাত হয়ে তিন দিনের রিমান্ডে এখন ডিবি (ডিএমপি) হেফাজাতে আছেন মিল্টন সমাদ্দার।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবে দেখা যায়, অনেক দরদ ও ভালোবাসা দিয়ে রাস্তা থেকে অসুস্থ ও ভবঘুরেদের কুড়িয়ে এনে তিনি আশ্রয় দিতেন। এ জন্য মিল্টন সমাদ্দার গড়ে তুলেছেন ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ নামের একটি বৃদ্ধাশ্রম। বিশেষ করে তিনি অসহায় মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার নামে, তাদের কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে বিক্রি করতেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মিল্টন বাস্তবে আপন আত্মীয় নয়, এসব মানুষের জন্য কংস মামা (নির্দয় আত্মীয়) হিসেবে পরিচিত হয়েছেন।

মিল্টন সমাদ্দারের ব্যক্তিজীবনেও নৈতিকতা বা মানবিকতার বালাই নেই। কিশোর বয়স থেকেই ছিলেন অর্থলোভী। প্রতিবেশী, চিকিৎসক কিংবা সাংবাদিকরা বিভিন্ন সময় তার কাছে শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। এমনকি নিজের জন্মদাতা পিতাকেও বেধড়ক মারধরের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এদিকে ১ মে বুধবার ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ আশ্রমের চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। অভিযান চালিয়ে ওই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ডিবি পুলিশের একটি দল রাজধানীর মিরপুর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করেছে। এরপর গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাকে হাজির করা হয়। ভুয়া মৃত্যু সনদ প্রদানের অভিযোগে রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় করা মামলায় মিল্টন সমাদ্দারের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. তোফাজ্জল হোসেনের আদালত শুনানি শেষে এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। অন্যদিকে আসামিপক্ষ রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে আবেদন করেন।

শুনানিতে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু বলেন, তার বিরুদ্ধে ভয়াবহ অভিযোগ রয়েছে। সে চিকিৎসক না হওয়া সত্ত্বেও মৃত্যু সনদ প্রদান করত। চক্রের সঙ্গে যারা জড়িত আছে তাদের শনাক্ত এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে সাত দিনের রিমান্ড প্রত্যাশা করেছি।

এ সময় শুনানিতে আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেন, চিকিৎসক হিসেবে মৃত্যু সনদ দিয়েছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। মিল্টন সমাদ্দার এসএসসি পাস করল, না মাস্টার্স ডিগ্রি পাস করল সেটা ব্যাপার নয়। মিল্টন যদি রাস্তার পচাগলা দুস্থ মানুষদের সেবা করে, তাহলে কেন সে মানবতার ফেরিওয়ালা হবে না। মিল্টন সমাদ্দার ভালো কাজ করেছে, কিন্তু সে চক্ষুশূল হয়েছে। প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে। হয়রানি ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে তাকে ফাঁসানো হয়েছে। এ মামলায় কোনোভাবে রিমান্ড হতে পারে না। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

টর্চার সেলে মানুষজনকে মারধর করার অভিযোগে মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছে। মিরপুর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মুন্সী ছাব্বির আহমেদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। জাল মৃত্যু সনদ তৈরির করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে প্রথম মামলাটি হয়। এরপর তার আশ্রমের টর্চার সেলে মানুষকে মারধর করার অভিযোগে আরো একটি মামলা করা হয়েছে। সর্বশেষ তার বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে আরো একটি মামলা হয়েছে। মামলার বাদী হয়েছেন রাজধানীর জিগাতলার বাসিন্দা এম রাকিব (৩৫)।

মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে জাল সনদ জালিয়াতির মামলা করেছে। লাশ দাফনের জন্য জালিয়াতি করে কাগজ তৈরির অভিযোগে করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায় ডিবি পুলিশ।

অন্যদিকে অন্তত ৯০০ জনকে বেওয়ারিশ দাবি করে দাফন করেন চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের মিল্টন সমাদ্দার। এসব নিয়ে ফেসবুকে লাইভও করেন তিনি। বিভিন্ন সময় তাদের রাস্তা থেকে তুলে আনেন নিজের প্রতিষ্ঠিত পুনর্বাসন কেন্দ্র চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে। দাফনের আগে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে রাখার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

কিন্তু সরকারি সংস্থার অনুমোদন ছাড়া পরিচয়হীন বা বেওয়ারিশ হিসেবে কাউকে দাফন করতে পারে না কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। এজন্য নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়, বলছে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম।

জনকল্যাণ সংস্থা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মুখপাত্র মোহাম্মদ আজিম বখশ বলেন, ‘বেওয়ারিশটা ডিক্লেয়ার করবে তো সরকার। অন্তত স্থানীয় কাউন্সিলর অবগত থাকলে, তখন বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা যেতে পারে। কাউকে দাফন করার উদ্যোগ নেওয়া হলেই দাফন করা যায় না। অনুমতি না নিলে মামলাও হয়ে যেতে পারে।’

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে অজস্র অভিযোগ। মানবতার ফেরিওয়ালার মুখোশের আড়ালে ভয়ংকর সব প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে। এমনকি অসহায় মানুষের নামে সংগ্রহ করা অর্থ আত্মসাৎ এবং তাদের কিডনিসহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চুরির মতো গা শিউরে ওঠা অভিযোগও রয়েছে। তার বাড়ি বরিশালের উজিরপুরে। বাবাকে পেটানোর কারণে এলাকাবাসী তাকে এলাকাছাড়া করে। এরপর ঢাকায় চলে আসে সে।

ডিবিপ্রধান বলেন, অভিযোগের বিষয়ে তার স্ত্রীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে তা জঘন্য অপরাধ। প্রমাণ মিললে তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। একাধিক মামলা হবে। মিল্টনের বিরুদ্ধে মানবপাচার, শিশুদের ওপর হামলা, আত্মীয়স্বজন গেলে তাদের মারপিট এবং তার টর্চার সেল, সবকিছুই মামলার মধ্যে আসবে।

হারুন অর রশীদ আরো বলেন, মিল্টন ঢাকায় এসে শাহবাগে ফার্মেসিতে কাজ শুরু করেন। ওষুধ চুরি করে বিক্রির কারণে মিল্টনকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর একজন নার্সকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ স্থাপনের জন্য স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন।

তিনি বলেন, মিল্টনের বিরুদ্ধে আমরা অজস্র অভিযোগ পেয়েছি। তিনি বলেছেন, তার দুটি আশ্রম রয়েছে। সাভারের আশ্রমে ৫০০ থেকে ৭০০ লোক রয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে ২০ থেকে ৩০ জনের বেশি লোক নেই।

তিনি বলেন, মিল্টনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করব, তিনি কত জন মানুষের কাছে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। তার আশ্রমে থাকা কত মানুষ মারা গেল। আশ্রমে যে অপারেশন থিয়েটার রয়েছে, এর মাধ্যমে কিডনি বিক্রি করেছেন কি না, সেটিও তদন্ত করা হবে।

ডিবিপ্রধান আরো বলেন, মিল্টন সমাদ্দার নিজেই কেন ডেথ সার্টিফিকেট নিজের স্বাক্ষরে তৈরি করেছেন এবং সেখানে চিকিৎসকের কোনো সই নেই, সেগুলো খুঁজে বের করা হবে। আমরা সবকিছু তদন্ত করে পরবর্তী সময়ে আপনাদের জানাব। আমরা তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ পেয়েছি, সেগুলো তদন্ত করে তাকে রিমান্ডে নিয়ে পরবর্তী বিষয়গুলো জানাব।

এখন যারা আশ্রমে রয়েছেন তাদের কার্যক্রম চলবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মিল্টনের লোকজন সেখানে রয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই আশ্রমের কার্যক্রম চলবে।

এর আগে গত ২৫ এপ্রিল একটি পত্রিকার প্রিন্ট ভার্সনে ‘মানবিক মুখোশের আড়ালে ভয়ংকর মিল্টন সমাদ্দার’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীর দক্ষিণ পাইকপাড়ায় মিল্টন সমাদ্দারের বৃদ্ধাশ্রমের কাছেই বায়তুল সালাম জামে মসজিদ। বৃদ্ধাশ্রমে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের একসময় এই মসজিদেই বিনামূল্যে গোসল করানো হতো। তার মানবিক কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে মসজিদ কর্তৃপক্ষ তাকে এই সুবিধা দিয়েছিল। তবে গোসল করানোর সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা প্রায় প্রতিটি মরদেহের বিভিন্ন স্থানে কাটাছেঁড়ার দাগ শনাক্ত করেন।

মিল্টন সমাদ্দারকে দীর্ঘদিন ধরে চেনেন স্থানীয় একটি মাদ্রাসার পরিচালক তোফাজ্জল হোসেন। তিনি ওই গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মিল্টন এক সময় বাসা ভাড়া শোধ করতে পারতেন না। এখন তিনি এগুলো করে কোটি কোটি টাকার মালিক। দামি গাড়িতে চড়েন। আড়ালে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চুরি করেন। আমাদের বায়তুল সালাম মসজিদে ওর মরদেহ ফ্রি গোসল করিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিছু মরদেহ গোসল করানোর পর দেখা যায়, সবগুলোর শরীরে কাটা দাগ। এ বিষয়ে মিল্টনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি মরদেহ পাঠানো বন্ধ করে দেন।’

প্রতিবদনে আরো বলা হয়, মানুষের কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে বিক্রির মতো ভয়ংকর অপকর্মের পাশাপাশি বহু অভিযোগ রয়েছে মিল্টনের বিরুদ্ধে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, তার আবেদনে সাড়া দিয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ১৬টির বেশি নম্বর এবং তিনটি ব্যাংক হিসাবে প্রতি মাসে প্রায় কোটি টাকা জমা হয়। এর বাইরে অনেকেই তার প্রতিষ্ঠানে সরাসরি অনুদান দিয়ে আসেন। মানবিক কাজের জন্য এখন পর্যন্ত তিনটি রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও পেয়েছেন মিল্টন সমাদ্দার। যদিও কয়েকটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন মিল্টন সমাদ্দার।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads